শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হয়।কথাটি কেবল কথার কথা নয়।এই মহান পেশায় যারা নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তারা অবশ্যই মহানুভব। সাদামাটা ভাবে আমরা সকলেই বলে থাকি,শিক্ষকরা মহান পেশায় আছেন। কিন্তু মন থেকে কি আমরা সকলে সত্যিই তা বিশ্বাস করি?

আমরা সকলে বুকে হাত দিয়ে একবার চোখ বন্ধ করে কথাটি অনুভব করতে চেষ্টা করি,দেখুন মন কি বলে? আজ থেকে চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর পেছন দিকে আমরা ফিরে তাকাই – সেসময় শিক্ষকের নিকট তুলে নিয়ে বলা হতো আপনার সন্তান, আপনার করে গড়ে তুলুন।শিক্ষক ছিলেন গুরু, ছাত্র তখন শিষ্য ।শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষার সাথে দিতেন দীক্ষা। ছাত্র বাড়ি ফিরে এসে শিক্ষকের বিরুদ্ধাচারণ ছিল মহাপাপের সামিল।সবচেয়ে গর্হিত কাজ। ছাত্র শিক্ষকের বিরুদ্ধাচরণের পূর্বে নিজের কাছেই কৈফিয়ত দিতে হতো তার ভুল কোথায়। পিতামাতা, গুরুজন একবাক্যে প্রশ্ন রাখতেন ছাত্রকে,তুমি নিশ্চয়ই গুরুতর অন্যায় করেছো।পিতামাতা, গুরুজন সহ ছাত্র শিক্ষকের কাছে হাজির হয়ে ক্ষমা চেয়ে দোয়া নিতেন। বর্তমান প্রেক্ষাপট আমাদের সকলের জানা।তার আলোকপাত নাই-বা করলাম। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে আমরা কেন শিক্ষকের হাতে তুলে দিয়েও গুরু শিষ্যের সেই দীক্ষার জায়গায় নিতে পারছি না। তার জন্য কি এই প্রজন্ম দায়ী? নাকি ভুলটা আমরা করেছি? বিষয়টি ভাবার সময় এসেছে।

আমরা যারা ৭০/৮০ দশকের প্রজন্ম আমরা কি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছি /পেরেছি? ঘাটতি কোথায়? কথায় কথায় মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে বলছি, মানবিক শিক্ষায় কি সন্তানকে গড়ে তুলতে পারছি? সকল শিক্ষারই সূতিকাগার হচ্ছে পরিবার তথা পিতামাতা ও পরিজন। বর্তমান শিশুরা পরিবার পাচ্ছে কিন্তু পরিজন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পিতামাতার নিকট সন্তান হচ্ছে আত্মার একটি অংশ।শিশু একটি নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছালেই তাকে শিক্ষক তথা বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দেন সন্তানকে শিক্ষা তথা সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে। পিতামাতা যত অর্থ বিত্তের অধিকারী কিংবা বিত্তশালী হোননা কেন শিশুকে অবশ্যই বিদ্যালয়ে কিংবা সমমানের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের নিকট পাঠিয়ে দেন।শিশুরা তখন শিক্ষকের সবকিছুই সঠিক মনে করেন। পিতামাতা তখন শিক্ষার ব্যাপারে গৌণ হয়ে যান। তাই শিশু যদি সঠিক শিক্ষা তথা মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয় তার দায় শিক্ষক কিছুতেই এড়াতে পারেন না।এড়াতে পারেন না বলেই তাদের পেশাকে মহান পেশা বলা হয়।শিশুকে মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করলেই মানবিক পরিবার তথা সমাজ, জাতি, দেশ ও বিশ্বকে পাওয়া যাবে। তাই মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে শিক্ষকের করণীয় রয়েছে অনেক কিছু। তারই কিছু আলোকপাত করা যাক।


শিক্ষক অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ, কর্তব্যনিষ্ঠ ও সচ্চরিত্রের অধিকারী হবেন। মানবীয় গুণাবলীর জন্য তিনি সকলের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হবার ব্রত নিবেন।শিক্ষা শুধু পুঁথিতে লিপিবদ্ধ কিছু কথা নয়।শিক্ষা একজন মানুষকে সুন্দর করে। সুন্দর বলতে দৈহিক সৌন্দর্যকে বুঝানো হচ্ছে না। দৈহিক সৌন্দর্য সৃষ্টিকর্তার দান।সুন্দর বলতে চলার সৌন্দর্য, বলার সৌন্দর্য, আচার-আচরণের সৌন্দর্য, সংযমের সৌন্দর্য বুঝানো হচ্ছে। এ-ই সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে শিক্ষকের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেজন্যে শিক্ষক হবেন একজন বিশ্বস্ত কাউন্সিলর।তিনি কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে শিশুর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে সৌন্দর্যকে পরিস্ফুটনের পথিকৃৎ হবেন। কাউন্সিলিং প্রক্রিয়াটির চিত্র হবে প্রবাহমান ও চক্রাকার।কাউন্সিলিং শুধু ছাত্র -শিক্ষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো প্রক্রিয়া নয়,এটি শিক্ষক-পিতামাতার মধ্যেও চলতে হবে। কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীর একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার প্রত্যয়ে শিক্ষার্থীর মনের সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটিয়ে পৃথিবীকে একটি নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলবেন। কেননা অধ্যয়নকালে একজন শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান।অনেকগুলো শিক্ষার্থীকে একসাথে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাওয়ায় শিক্ষক সহজেই শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য বুঝতে সক্ষম হন।যা অনেক সময় পিতামাতা/অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব হয়না।

শিশুর মানবিক বিকাশে সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলোতে শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পিতামাতা/অভিভাবকদের এব্যাপারে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। অনেক অভিভাবক গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরে সৃজনশীল কাজে শিশুদের সম্পৃক্ততাকে সময়ের অপচয় মনে করেন।সৃজনশীলতার বিকাশ ছাড়া মানবিক বিকাশ ব্যহত হয় বিষয়টি অভিভাবকদের বুঝাতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে শিশুকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ক্যাম্পেইনে সহযোগিতা করা,জাতীয়দিবস সহ বিভিন্ন দিবসে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা,দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ান নিশ্চিত করতে হবে। সৃজনশীল বিকাশ ছাড়া সমাজকে আলোকিত করা সম্ভব নয়। আলোকিত শিশুই হবে আলোকিত ভবিষ্যৎ। চারু কারু, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা বিষয়গুলোর প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। শরীরের যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি মনেরও খাদ্যের প্রয়োজন রয়েছে। মনের খাদ্য যোগান নিশ্চিত করতেই সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো জোরদার প্রয়োজন। সুস্থ মনই মানবিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

একজন শিক্ষার্থীকে দাতা হিসেবে গড়ে তোলার কাজটা শুরু করতে হবে ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই। ছোট ছোট জিনিস, কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া, নিজের জন্য শুধু প্রয়োজনীয়টুকু রেখে বাকিটুকু অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া,নিজের টিফিন থেকে অন্যকে শেয়ার করা, যে বন্ধুটি টিফিন আনতে পারেনি তাকে নিয়ে একসাথে খাওয়া – বিষয়গুলো খুব সাধারণ মনে হলেও এসব কর্মকান্ডই একজন শিশুকে ভবিষ্যতে একজন দাতা মনোভাবের গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। তাই এসব গুণগুলো গড়ে তুলতে শিক্ষকের ভুমিকা নিতে হবে অগ্রগণ্য।

সৎ কাজে উৎসাহিত করতে শিশুদের পুরস্কৃত করতে হবে। পুরস্কার অর্থমূল্যের হতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী একসাথে থাকে তাই তাদের কিছু হারিয়ে গেলে অন্য কেউ সেটা পেলে তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে দিলে সেটা যে মাধ্যমেই ( নিজে / শিক্ষকের কাছে জমা দেয়া) হোকনা কেন হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সকলের মাঝে তার প্রশংসা করা,অন্যান্য শিক্ষার্থীদের নিকট বিষয়টি প্রকাশ করে হাততালির মাধ্যমে সম্মান জানানো- এসবের মাধ্যমে শিশুকে পুরস্কৃত করা যায়। ফলে অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ভালো কাজের প্রতিযোগিতা বাড়বে। তাই শিক্ষক সবসময় যেকোনো ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়ে ভবিষ্যতের সৎ মানুষ তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রাখতে হবে।

বর্তমান প্রজন্ম করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। মহামারীর নিষ্ঠুরতা,ভয়াবহতা দেখে তাদের কোমল হৃদয় বিশাল ধাক্কা খেয়েছে,যা আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছি না। কিন্তু এই ধাক্কার প্রভাব কাটাতে চাই সঠিক শিক্ষা এবং অবশ্যই তা মানবিক শিক্ষা। যে জাতি যত বেশি উন্নত,যে দেশ যত বেশি এগিয়েছে তাদের জনশক্তি তত বেশি শিক্ষিত এবং তা অবশ্যই মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত। টেকসই উন্নয়নে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে তাই সকলের সাথে আমাদের শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

খাদিজা খাতুন
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ।